শরবত একটি উৎপাদিত দ্রব্য । শরবত উৎপাদন করতে পানি, চিনি, লেবু ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। উপকরণ ব্যবহার করে দ্রব্য উৎপাদন এবং তা ভোগের মাধ্যমে উপযোগ বা তৃপ্তি সৃষ্টি করা যায় । উৎপাদন কাজটি করে থাকে সংগঠন । উৎপাদন করতে উপকরণ যেমন পানি, চিনি, লেবু লাগে, কীভাবে উৎপাদন করবে তার একটি পরিকল্পনা করতে হয় এবং উৎপাদন করার সময় বিভিন্ন জন বিভিন্ন কাজ করেন— যোগ্যতা অনুযায়ী এই কাজগুলো বণ্টন করতে হয়, উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বাজারে নিতে হয়। এ ধরনের কাজগুলো করে সংগঠন। যে ব্যক্তি সংগঠনের মূল দায়িত্ব পালন করেন, তাকে বলা হয় উদ্যোক্তা ৷ সংগঠন বা উদ্যোক্তা দক্ষ না হলে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না ।
উৎপাদন বলতে মূলত উপযোগ সৃষ্টি করাকে বোঝায় । উৎপাদিত দ্রব্যের বিনিময় মূল্য থাকতে হবে । আবার উপযোগ সৃষ্টি না হলে উৎপাদন বোঝায় না। উপকরণ বা প্রাথমিক দ্রব্য ব্যবহার করে নতুন কোনো দ্রব্য বা উপযোগ সৃষ্টি করাকে উৎপাদন বলে। যেমন-আটা, লবণ, পানি, বেলুন ইত্যাদি ব্যবহার করে রুটি বানানো হয় । রুটি একটি উৎপাদিত নতুন দ্রব্য । রুটি খেয়ে আমরা ক্ষুধা নিবারণ করি বা তৃপ্তি পাই । অর্থাৎ রুটি তৈরি করে উপযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে । আমরা টাকা বা অন্য দ্রব্যের বিনিময়ে রুটি পেতে পারি । অর্থাৎ নতুন দ্রব্য রুটির বিনিময় মূল্য আছে । ব্যবসা করার জন্য রুটি বানানো হলে অনেক সময় রুটিগুলো বাজারে নিয়ে যেতে হয় । উপকরণ সংগ্রহ থেকে বাজারে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব কাজ তদারকি করে সংগঠন বা সংগঠন পরিচালক উদ্যোক্তা। যেমন কী উপকরণ লাগবে, কোথা থেকে উপকরণ আনবে, কে আনবে, কে লবণ, আটা, পানি মিশিয়ে খামির তৈরি করবে, কে রুটি বেলবে, কে সেঁকবে, কে বাজারে নিবে, কত দামে বিক্রয় করবে, এই সবই দেখে সংগঠন বা সংগঠন পরিচালক উদ্যোক্তা। সব কিছু সংগঠন দক্ষতার সঙ্গে তদারকি না করতে পারলে নির্দিষ্ট পরিমাণ উপকরণ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হবে না । একই ব্যক্তি সংগঠক এবং উৎপাদক হতে পারে । যেমন : যে ছোট/মাঝারি কৃষক নিজে নিজের জমিতে ফসল উৎপাদন করছেন, তিনি একই সাথে উৎপাদক এবং সংগঠক। কিন্তু যে কারখানার মালিক ম্যানেজার হিসেবে শ্রমিকদের দ্বারা কারখানা চালাচ্ছেন তিনি সংগঠক হলেও উৎপাদক নন। আবার যে কারখানার মালিক ম্যানেজার রেখে শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন করাচ্ছেন তিনি সংগঠকও নন, , উৎপাদকও নন তিনি নিছক মালিক। আবার যে মালিক নিজে উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করছেন এবং অন্য উৎপাদকদের তত্ত্বাবধান করছেন, তিনি হচ্ছেন একই সঙ্গে মালিক-উৎপাদক-সংগঠক।
উৎপাদনে উপযোগ সৃষ্টি পাঁচ ভাগে দেখানো যায় । যেমন-
১. রূপগত উপযোগ : দ্রব্যের রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন দ্রব্য উৎপাদন করাকে রূপগত উপযোগ বলে । যেমন, কাঠকে সুবিধামতো পরিবর্তন করে খাট, চেয়ার, টেবিল বানানো হয় । খাট, চেয়ার, টেবিল হলো রূপগত উৎপাদন ।
২. স্থানগত উপযোগ : কোনো কোনো দ্রব্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করলে তার উপযোগ বাড়ে । যেমন, বনের কাঠ সাধারণত বনের আশপাশের লোকজন খড়ি হিসেবে ব্যবহার করে । শহরে আনলে মানুষ এই কাঠ দিয়ে আকর্ষণীয় আসবাবপত্র বানাতে পারে- ফলে এর উপযোগ বাড়ে ৷ আবার বনে ফুলের তেমন কদর নেই । কিন্তু সেই ফুলসহ গাছ শহরের বাড়ির আঙিনায় রাখলে এর কদর বাড়ে অর্থাৎ উপযোগ বাড়ে ।
সময়গত উপযোগ : কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধানে অনেক জিনিসের উৎপাদন না বাড়লেও উপযোগ বাড়ে । এদেরকে সময়গত উপযোগ সৃষ্টি বলে। যেমন, পৌষ-মাঘ মাসে ধানের মৌসুমে ফলন বেশি হয় । আবার এই সময়ে ধানের দাম কম থাকে। এ সময় ধান মজুদ করে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে বিক্রি করলে বেশি দাম পাওয়া যায় । এখানে ধানের উৎপাদন হ্রাস বা বৃদ্ধি না পেলেও তার উপযোগ বা দাম বর্ধিত হবে।
৪. সেবাগত উপযোগ : মানুষ তার সেবা দ্বারা যে উপযোগ সৃষ্টি করে তাকে সেবাগত উপযোগ বলে । শিক্ষক শিক্ষাদান করে শিক্ষিত মানুষ তৈরি করে, ডাক্তার চিকিৎসা দিয়ে মানুষের শরীরকে সুস্থ রাখে বা উৎপাদন ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখে বা বৃদ্ধি করে ।
৫. মালিকানাগত উপযোগ : কোনো কোনো অর্থনৈতিক দ্রব্য ও সেবার মালিকানা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত উপযোগ সৃষ্টি করা যায় । যেমন, অব্যবহৃত জমি কিনে একজন কৃষক চাষাবাদ করে উৎপাদন করতে পারে অথবা ব্যবহৃত জমি কিনে আরো ভালোভাবে চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে পারে ।
উপরে তোমরা উৎপাদনের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টির ধারণা পেলে । এবার তোমরা জানতে পারবে এই উৎপাদনের কাজটি কে বা কারা করে । রমজান আলী একজন কৃষক। তাঁর তিন বিঘা কৃষিজমি রয়েছে । এই জমিতে রমজান নিজেই এক ঋতুতে ধান উৎপাদন করেন, অন্য ঋতুতে গম উৎপাদন করেন। ধান ও গম উৎপাদনের মাঝখানে সবজি চাষ করেন । এই সব উৎপাদনের জন্য উপকরণ হিসাবে বীজ, সার, পানি, কীটনাশক, ধান-গম কাটা ও মাড়াই যন্ত্র ব্যবহার করেন । এই সব কাজে পরিবারের লোকেরাও তাকে সহযোগিতা করে।
মনে কর তোমার এলাকায় গম, আলু, কলা, ধান, ইত্যাদি কৃষিপণ্য এবং কাপড়, বিস্কুট, প্লাস্টিক ইত্যাদি শিল্পপণ্য উৎপাদিত হয়। এই কৃষিপণ্য ও শিল্পপণ্য উৎপাদনে অনেকগুলো উপকরণের প্রয়োজন হয় । কৃষকের ধান উৎপাদন করতে জমি, বীজ, সার, লাঙ্গল, সেচ, শ্রমিক ইত্যাদির প্রয়োজন হয় । আবার শিল্পপণ্যের জন্য কারখানা, বিল্ডিং, কাপড়, সুতা, মেশিন, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ময়দা, চিনি, তৈল, শ্রমিক লাগে । এসব দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে আবার প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন মাটি, মাটির উর্বরতা শক্তি, আলো-বাতাস, পরিবেশ, খনিজ দ্রব্য, সূর্য কিরণ, পানি, আরও অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় । এখানে যেসব দ্রব্যের কথা বলা হলো, এগুলো হচ্ছে উৎপাদনের উপকরণ । অতএব কোনো কিছু উৎপাদনের জন্য যেসব দ্রব্য বা সেবাকর্ম প্রয়োজন হয়,সেগুলোকে উৎপাদনের উপকরণ বলে ।
উৎপাদনের উপকরণ মূলত চার ধরনের হয়। যেমন : ১. ভূমি (Land), ২. শ্রম (Labour), ৩. মূলধন (Capital), এবং ৪. সংগঠন (Organisation)
১. ভূমি : উৎপাদনে সাহায্য করে এমন সব প্রাকৃতিক সম্পদকে ভূমি বলে । যেমন, জমি, মাটি, মাটির উর্বরতা শক্তি, খনিজ দ্রব্য, বনজ ও জলজ সম্পদ, সূর্য কিরণ, বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া প্রভৃতি সব রকম প্রাকৃতিক সম্পদ ভূমির অন্তর্ভুক্ত ।
২. শ্ৰম : উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত মানুষের সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমকে শ্রম বলে । উৎপাদনে চাষি, জেলে, কামার, কুমার, তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকের কায়িক পরিশ্রমকে শ্রম বলে । আবার অফিস - আদালতের কর্মচারী-কর্মকর্তার শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমকেও শ্রম বলা হয় । একইভাবে শিক্ষকের শিক্ষাদান, ডাক্তারের সেবা ও উকিলের পরামর্শ এক ধরনের শ্রম ।
৩. মূলধন : মূলধন হলো মানুষ কর্তৃক উৎপাদিত উৎপাদনের উপকরণ । এই উৎপাদিত উপকরণ মানুষ ভোগ না করে নতুন দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করে। যেমন-যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কারখানা, অফিসের আসবাবপত্র প্রভৃতি ।
৪. সংগঠন : সংগঠনকে সমন্বয়কারী বলে । উৎপাদন ক্ষেত্রে ভূমি, শ্রম মূলধন ইত্যাদি উপকরণের মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয় ঘটিয়ে উৎপাদন কাজ পরিচালনা করাকে সংগঠন বলে। সমন্বয় ঘটানো এবং কাজ পরিচালনাকে ব্যবস্থাপনাও বলা হয়। এ কাজটি যে ব্যক্তি সম্পাদন করে থাকেন, তাকে সংগঠক বা উদ্যোক্তা বলে । তাই উদ্যোক্তার বিভিন্ন কাজ, যেমন, কোনো কিছু উৎপাদনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, ভূমি, শ্রম, মূলধন একত্রীকরণ ও তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন কাজ পরিচালনা -এসবই সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ।
সুতরাং সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থায় ভূমি, শ্রম, মূলধন এবং সংগঠন-এ চারটি উপকরণের যৌথ অংশগ্রহণ অপরিহার্য । এগুলোর মধ্যে যেকোনো একটির অনুপস্থিতিতে উৎপাদন সম্ভব নয় । অবশ্য উৎপাদন ক্ষেত্রে সব উপকরণের গুরুত্ব এক রকম নয়। অবস্থাভেদে কোনো উপকরণ বেশি আবার কোনো উপকরণ কম প্রয়োজন হয় । বাংলাদেশ কৃষি প্রধান ও জনবহুল দেশ বলে এখানে মূলধনের তুলনায় ভূমি ও শ্রমের গুরুত্ব বেশি। আবার উন্নত শিল্প প্রধান দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান প্রভৃতি দেশে ভূমি ও শ্রমের তুলনায় মূলধনের গুরুত্ব বেশি ।
আয়েশা বেগম তাঁর সংসারের যাবতীয় কাজের ফাঁকে বাড়িতে একটি হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন । এই খামার থেকে সারা বছরই কমবেশি ডিম উৎপাদিত হয়। এক বছর পর সরকারি মাছের খামার দেখতে যান আয়েশা এবং এর পর থেকে তাঁর মাথায় হাঁস-মুরগির খামারের পাশাপাশি মাছ চাষ করার আগ্রহ জাগে। এক বছরে হাঁস-মুরগির খামার থেকে ডিম বিক্রির নিট আয় বিশ হাজার টাকা দিয়ে তিনি বাড়ির পাশে ২ বিঘা জমিতে পুকুর করে বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ শুরু করেন । দুটি খামারে নতুন করে কয়েকজন শ্রমিক নিয়োগ পায় । হাঁস-মুরগির খামার থেকে ডিম বিক্রি এবং এক বছর পরে পুকুরের মাছ বিক্রি শুরু হলে আয়েশার উপার্জন বাড়তে থাকে । তিনজন সন্তানের পড়াশোনার খরচ এবং সংসারের অন্যান্য যাবতীয় খরচ মিটিয়ে আয়েশার সঞ্চয়ও বাড়তে থাকে । আয়েশার মাছ ও হাঁস-মুরগির খামারের কাজকর্ম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর স্বামী রহমত আলী শহরের চাকরি ত্যাগ করে গ্রামে স্ত্রীর খামারে যোগ দেন। উভয়ের প্রচেষ্টায় তাঁরা বেশ কিছু জমি, হাঁস-মুরগি এবং মাছ চাষের আওতায় নিয়ে আসেন । ১২ জন নারী-পুরুষ শ্রমিকও নিয়োগ করেন । প্রত্যেক শ্রমিকের কাজও বুঝিয়ে দেন তাঁরা। আয়েশা এবং রহমত পালাক্রমে শ্রমিক কর্মচারী এবং খামারসমূহ তদারক করেন । ডিম ও মাছ বাজারজাত করে বেচা-কেনার ব্যবস্থাও করেন তাঁরা । তাদের সাফল্য দেখে গ্রামের অনেকে তাঁদের অনুসরণ করে গ্রাম ও এলাকা জুড়ে হাঁস-মুরগির খামার এবং মাছ চাষ শুরু করেন । ডিম ও মাছ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকার নিয়মিত আসে আয়েশার গ্রামে । কয়েক বছরে এলাকাটি কৃষি, হাঁস-মুরগির খামার ও মাছ চাষাবাদ করে অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করে । এলাকায় এখন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হাঁস-মুরগি ও মাছ উৎপাদন করা যায় ।
আমরা কি বলতে পারি যে আয়েশা বেগম একজন সংগঠক? তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা কি বিকাশ লাভ করেছে?
উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিশ্চিত যে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করাকে সংগঠন বলে । সত্যিকার অর্থে সংগঠন ছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনা প্রায় অসম্ভব। আধুনিক বিশ্বে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন জন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন । এ দায়িত্ব সংগঠক দক্ষতার সাথে যোগ্যতা অনুযায়ী ভাগ করে দেন । এভাবে কর্মীদের সহায়তায় উৎপাদন ও ব্যবসায়ের বিভিন্ন কার্যবলি সম্পাদিত হয়। কিন্তু এই কার্য সম্পাদনে কর্মীদের মধ্যে একটি পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব সৃষ্টি হয়। পারস্পরিক এই অধিকার ও দায়িত্ব কাঠামোই সংগঠন । সুতরাং সংগঠন হচ্ছে ব্যবসায়ের ভিত্তি ।
সংগঠনের বিভিন্ন অংশ একসঙ্গে ধরে রাখা এবং লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় রূপরেখা তৈরি সাংগঠনিক কাঠামোর কাজ । তাছাড়া বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব বণ্টন, নিয়ম-শৃঙ্খলা গড়ে তোলা ইত্যাদি সাংগঠনিক কাঠামোর অন্তর্গত । ব্যবসায়ের আয়তন, উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ, শিল্পের প্রকৃতি, উৎপাদন প্রক্রিয়া, শ্রমিকের দক্ষতা প্রভৃতির উপর ব্যবসায়ের সাংগঠনিক কাঠামো নির্ভরশীল । সংগঠনের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সম্মিলিত উৎপাদন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উৎপাদনের বা আয়ের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা। তা না হলে কোনো সামাজিক সংগঠনই টেকসই হয় না ।
ব্যবসায়ের সাংগঠনিক কাঠামোর বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ ও শাখার কাজকর্ম নির্দিষ্ট করে ভারপ্রাপ্ত উর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মীদের পদগুলো ক্রমানুসারে সাজালে তা হতে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কাঠামোর যে সুস্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায় তাকে সংগঠনের চিত্র বলে। সংগঠন ব্যবস্থাপনা যত সুন্দর ও সুষ্ঠু হবে ব্যবসায়ের সাফল্য তত বেশি হবে । সুতরাং সংগঠনই হলো ব্যবসায়ের বা যে কোন সামাজিক উৎপাদনের মৌলিক ও প্রধান বিষয় । কাজ : সাংগঠনিক কাজের একটি তালিকা তৈরি কর ।
একটি ভালো সংগঠনের কতগুলো প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্য থাকে । তা হচ্ছে-
১. ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি : সংগঠনের প্রথম ধাপে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য কী হবে তা নির্ধারণ করতে হয় । ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি অনুসারে ব্যবসায়ের সাংগঠনিক রূপ তৈরি করতে হয় । এই উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে কোনটি মুখ্য, কোনটি গৌণ, কোনটি স্বল্পমেয়াদি এবং কোনটি দীর্ঘমেয়াদি তা নির্ধারণ করে নিতে হয় ।
২. ব্যবসায়ের কার্যাবলি নির্ধারণ : ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ঠিকমতো নির্ধারণ করার পর ব্যবসায়ের সমগ্র কার্যাবলি বিশ্লেষণ করা হয় । যেমন, উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয়, অর্থসংস্থান, শ্রমিক-কর্মী নিয়োগ, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক প্রভৃতি। সে জন্য প্রয়োজন হয় হিসাবরক্ষণ, বিজ্ঞাপন ও প্রচার, পণ্য মজুদ, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ।
৩. কার্যাবলির বিভাগ : কার্যাবলি বিশ্লেষণের পর কাজের ধরন ও উদ্দেশ্যের মিল অনুযায়ী কাজগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। একই বিভাগের সহায়ক কাজগুলোকে আবার উপবিভাগে ভাগ করা হয় । যেমন, উৎপাদন বিভাগ, ক্রয় বিভাগ, বিক্রয় বিভাগ, হিসাবরক্ষণ বিভাগ, প্রচার বিভাগ ইত্যাদি । অনেক সময় কোনো কোনো ব্যবসা আঞ্চলিক ভিত্তিতেও ভাগ করা হয় । কয়েকটি শাখা একত্রে আঞ্চলিক বিভাগ হিসাবে গণ্য হয় ।
৪. কর্তব্য বণ্টন : ব্যবসায়ের প্রতিটি কর্মীর উপর একটি নির্দিষ্ট কাজের ভার অর্পণ করা হয় । অভিজ্ঞতা, ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুসারে প্রতিটি বিভাগে ও উপবিভাগের প্রতিটি কর্মীর সুনির্দিষ্ট কর্তব্য স্থির করা হয় এবং যে কর্মী যে কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ, তাকে সেই কাজই দেওয়া হয় ।
৫. অধিকার ও ভার বণ্টন : ভার অর্পণ বলতে কর্তব্য পালনের উপযুক্ত কার্যনির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করাকে বোঝায় । প্রতিটি কর্মীকে স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে এবং যথাযথভাবে কাজ করার অধিকার দিতে হয়। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার একাংশ তাঁর অধস্তন কর্মীকে অর্পণ করেন । আবার অধস্তন কর্মী তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিকট কাজের কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকেন। উপর থেকে নিচে এবং নিচ থেকে উপরে এই দুটি ভিন্নমুখী প্রবাহ অব্যাহত থাকলে সংগঠন সফল হয়।
কমল বাবু তাঁর এক বিঘা জমিতে ১০ জন শ্রমিক নিয়োগ করে ৬০০ কুইন্টাল গম উৎপাদন করেন । এখানে গড়ে শ্রমিকপ্রতি ৬০ কুইন্টাল গম উৎপাদন হয় । শ্রমিক প্রতি এই ৬০ কুইন্টাল গম উৎপাদনকে গড় উৎপাদন বলে । পরের মৌসুমে ১১ জন শ্রমিক নিয়োগ করে ৬৫৫ কুইন্টাল গম উৎপাদন হয় । এখানে গত বছরের তুলনায় উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৫৫ কুইন্টাল । এই ৬৫৫ – ৬০০ = ৫৫ কুইন্টাল গম উৎপাদনকে প্রান্তিক উৎপাদন বলে । অর্থাৎ অতিরিক্ত একজন (১১তম) শ্রমিক নিয়োগ করায় উৎপাদন বাড়ল ৫৫ কুইন্টাল । ১১তম শ্রমিক হলো প্রান্তিক শ্রমিক । সুতরাং প্রান্তিক শ্রমিকের উৎপাদন হলো ৫৫ কুইন্টাল । তাহলে এখানে ৬০০ কুইন্টাল হচ্ছে ১০ জন শ্রমিকদের মোট উৎপাদন, ৬০ কুইন্টাল হচ্ছে শ্রমিক প্ৰতি গড় উৎপাদন এবং ৫৫ কুইন্টাল হচ্ছে ১১তম শ্রমিকের প্রান্তিক উৎপাদন। মোট, গড় এবং প্রান্তিক উৎপাদনকে চিত্রের সাহায্যে উপস্থাপন করা হলো ।
চিত্রে TP (Total Production) রেখা দ্বারা মোট উৎপাদন বোঝানো হয়েছে । মাত্র একটি উপকরণ ON পরিমাণ নিয়োগ করে E বিন্দুতে সর্বোচ্চ NE পরিমাণ মোট উৎপাদন হয় । এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে যে উৎপাদনের অন্য উপকরণগুলো স্থির (Fixed) রয়েছে।
গড় উৎপাদন : মোট উৎপাদনের পরিমাণকে মোট উপকরণ বা উপাদান (শ্রমিক) দ্বারা ভাগ করলে গড় উৎপাদন পাওয়া যায় । (এখানে আমরা অন্যান্য উপকরণ স্থির রেখে উপকরণ হিসেবে শ্রমকে নিয়েছি। অন্য উপকরণ নিয়েও গড় উৎপাদন বের করা যায়)।
গড় উৎপাদন :
মোট উৎপাদন
মোট শ্রম উপকরণ
প্রান্তিক উৎপাদন : এক একক উৎপাদনের উপকরণ পরিবর্তনের (অর্থাৎ শ্রম বা মূলধন) ফলে উৎপাদনের যে পরিবর্তন হয়, তাকে প্রান্তিক উৎপাদন বলে । শ্রম ব্যবহার করলে শ্রমের বা মূলধন ব্যবহার করলে মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদন বলব। অর্থাৎ এক একক মূলধন বা এক একক শ্রম বা একজন শ্রমিক বৃদ্ধির ফলে মোট উৎপাদনের যে পরিবর্তন হয়, তাকে প্রান্তিক উৎপাদন বলে । ৫১ নং পৃষ্ঠার সূচি থেকে দেখা যায় শ্রম উপকরণ ১ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২ হলে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ১০ থেকে ২২ কুইন্টাল হয়। এখানে প্রান্তিক উৎপাদন হচ্ছে (২২-১০) = ১২ কুইন্টাল । একইভাবে উপকরণ নিয়োগ ৩ তে বৃদ্ধি করলে মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩০ কুইন্টাল । এখানে প্রান্তিক উৎপাদন হলো (৩০-২২) = ৮ কুইন্টাল ।
গড় ও প্রান্তিক উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক : উৎপাদন-ব্যবস্থায় গড় উৎপাদন ও প্রান্তিক উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে । ৫০নং পৃষ্ঠার চিত্রে AP হচ্ছে গড় উৎপাদন রেখা এবং MP হচ্ছে প্রান্তিক উৎপাদন রেখা। চিত্রে দেখা যাচ্ছে –
১. প্রান্তিক উৎপাদন বাড়তে থাকলে গড় উৎপাদনও বাড়তে থাকে । অর্থাৎ প্রান্তিক উৎপাদন যখন গড় উৎপাদনের চেয়ে বেশি থাকে, তখন গড় উৎপাদন বাড়ে । এ জন্য প্রান্তিক উৎপাদন রেখা গড় উৎপাদনের উপরে থাকে । চিত্রে ON, উপকরণ নিয়োগ স্তরে প্রান্তিক উৎপাদন, গড় উৎপাদনের চেয়ে বেশি ।
২. প্রান্তিক উৎপাদন যখন গড় উৎপাদনের উপরে থাকে এবং কমতে থাকে, তখন গড় উৎপাদন কম হারে বাড়ে। এ অবস্থায় কিছুদূর পর্যন্ত গড় উৎপাদন রেখা প্রান্তিক উৎপাদন রেখার নিচে থাকে এবং বাড়তে থাকে। চিত্রে ON 2 উপকরণ নিয়োগ স্তরে গড় উৎপাদন, প্রান্তিক উৎপাদনের চেয়ে বেশি হলেও তা কমছে। ON পর্যায়ে এসে আমরা দেখছি যে প্রান্তিক উৎপাদন ও গড় উৎপাদন পরস্পর সমান হয়েছে। এরপর থেকে গড় উৎপাদন ও প্রান্তিক উৎপাদন উভয়ই হ্রাস পেতে থাকে এবং প্রান্তিক উৎপাদন গড় উৎপাদনের চেয়ে কম থাকে ।
মোট উৎপাদন : বিভিন্ন উপকরণ নিয়োগের দ্বারা যে উৎপাদন পাওয়া যায়,তাকে মোট উৎপাদন বলে ।
৩. গড় উৎপাদন যখন সবচেয়ে বেশি হয়, প্রান্তিক উৎপাদন রেখা তখন গড় উৎপাদন রেখার সর্বোচ্চ বিন্দুকে ছেদ করে । অর্থাৎ গড় উৎপাদনের সর্বোচ্চ বিন্দুতে গড় উৎপাদন ও প্রান্তিক উৎপাদন সমান হয় । চিত্রে ON উপকরণ নিয়োগ স্তরে E বিন্দুতে গড় ও প্রান্তিক উৎপাদন সমান ।
চিত্রে ভূমি অক্ষে (OX) শ্রম অথবা উপকরণ নিয়োগ এবং লম্ব অক্ষে (OY) শ্রম বা উপকরণের গড় ও প্রান্তিক উৎপাদন দেখানো হয়েছে । ON পরিমাণ উপকরণ নিয়োগের পূর্বে ON, উপকরণ নিয়োগ স্তরে MP, AP উভয়ই বৃদ্ধি পায়, তবে MP বেশি হারে বৃদ্ধি পায় । এ অবস্থাকে উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান স্তর বলে । এরপর ON উপকরণ নিয়োগ স্তরে AP সর্বোচ্চ হয় এবং AP ও MP সমান হয়। এই সংক্ষিপ্ত স্তরে প্রান্তিক উৎপাদন গড় উৎপাদনের চেয়ে বেশি কিন্তু ক্রমহ্রাসমান অন্যদিকে এই স্তরে গড় উৎপাদন ক্রমবর্ধমান এবং সর্বোচ্চ মাত্রার দিকে ধাবিত হয়। আবার ON উপকরণ নিয়োগের পর যেমন ON2 উপকরণ নিয়োগ স্তরে AP, MP উভয় কমতে থাকে, তবে AP-এর চেয়ে MP বেশি হারে কমে । অতএব গড় উৎপাদন ও প্রান্তিক উৎপাদনের মধ্যে তিন ধরনের সম্পর্ক হচ্ছে প্রান্তিক উৎপাদন প্রথম পর্যায়ে গড় উৎপাদনের চেয়ে বেশি (ON পর্যন্ত), তারপর প্রান্তিক উৎপাদন ON উপকরণ নিয়োগ স্তরে এসে গড় উৎপাদনের সমান হয় এবং পরবর্তী সময়ে প্রান্তিক উৎপাদন গড় উৎপাদনের চেয়ে কম হয় (NN2 পর্যন্ত)।
উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপাদন কৌশল ও অন্যান্য উপকরণ স্থির রেখে একটি উপকরণ বৃদ্ধির ফলে মোট উৎপাদন প্রাথমিকভাবে ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ে। এক পর্যায়ে উপকরণটি আরো বাড়ালে মোট উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ে । ফলে প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমশ কমে।
সাধারণত কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গেলে এই বিধিটি কার্যকর হয় । উল্লেখ্য, প্রথম দিকে উপকরণ বাড়ানোর তুলনায় উৎপাদন বেশি হারে বাড়তে পারে। মনে করি আমাদের ভূমি ও শ্রম দুটি উপকরণ আছে । ভূমির পরিমাণ স্থির । প্রথমে শ্রমের পরিমাণ কম থাকায় প্রান্তিক শ্রম বৃদ্ধি পেলে প্রান্তিক শ্রমের জন্য পর্যাপ্ত ভূমি থাকে । একারণে প্রান্তিক শ্রমের বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক উৎপাদন বেশি হয় । অর্থাৎ উৎপাদন ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ক্রমাগত বেশি পরিমাণ শ্রম নিয়োগ করতে থাকলে একটি পর্যায়ে এসে ভূমির তুলনায় শ্রম অনেক বেশি হওয়ায় শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমশ কমে । এর কারণ হলো অতিরিক্ত শ্রম নিয়োগ করায় প্রতি একক শ্রমের জন্য ভূমি কম থাকে । ফলে মোট উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ে । একে বলে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি । নিম্নের সূচি ও চিত্রের মাধ্যমে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি ব্যাখ্যা করা যায় ।
সূচির মাধ্যমে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি
ভূমি (ভূমির পরিমাণ স্থির) | শ্রম উপকরণ (শ্রমিকের শ্রমঘণ্টা) | উপকরণ সংমিশ্রণ | মোট উৎপাদন (কুইন্টাল) | প্রান্তিক উৎপাদন (কুইন্টাল |
---|---|---|---|---|
১ হেক্টর | ১ | A | ১০ | ১০ |
১ হেক্টর | ২ | B | ২২ | ১২ |
১ হেক্টর | ৩ | C | ৩০ | ৮ |
১ হেক্টর | ৪ | D | ৩৪ | ৪ |
উপরের সূচি থেকে দেখা যায়, ১ হেক্টর জমিতে শ্রম ক্রমাগত বৃদ্ধি করলে প্রথমে প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমবর্ধমান থাকে। পরবর্তীতে তা ক্রমশ: হ্রাস পায়। সংমিশ্রণ A অনুযায়ী ১ হেক্টর জমিতে ১ শ্রমঘণ্টা ব্যয় করে মোট ও প্রান্তিক উৎপাদন হয় ১০ কুইন্টাল। B সংমিশ্রণ অনুযায়ী শ্রমঘণ্টা ২ এ বাড়ালে মোট উৎপাদন ২২ কুইন্টাল এবং প্রান্তিক উৎপাদন (২২-১০) = ১২ কুইন্টাল হয় । এখানে উপকরণ ১ শ্রমঘণ্টা থেকে ২ শ্রমঘণ্টায় উন্নীত করলেও প্রান্তিক উৎপাদন পূর্বের তুলনায় ২ কুইন্টাল বেশি । প্ৰথম পর্যায়ের এই উৎপাদনকে ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক উৎপাদন বলে। একই ভাবে C সংমিশ্রণের ক্ষেত্রে এক শ্রমঘণ্টা (উপকরণ) বাড়ানোর ফলে মোট উৎপাদন বাড়ে । কিন্তু প্রান্তিক উৎপাদন ১২ কুইন্টাল থেকে ৮ কুইন্টালে নেমে আসে। অর্থাৎ প্রান্তিক উৎপাদন ক্রমহ্রাসমান হয়। উপকরণ বৃদ্ধির সঙ্গে প্রান্তিক উৎপাদন কম হওয়াকে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি বলে ।
রেখাচিত্রের সাহায্যে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধিটি ব্যাখ্যা করা হলো :
চিত্রে ভূমি অক্ষে (OX) শ্রমঘন্টা এবং লম্ব অক্ষে (OY) প্রান্তিক উৎপাদন দেখানো হয়েছে । চিত্রে শ্রমঘণ্টার ধাপসমূহ হচ্ছে ১,২,৩, ৪। এদের পরিপ্রেক্ষিতে প্রান্তিক উৎপাদনের পরিমাণ হলো Aa(10), Bb(12), Cc(8), Dd (4) কুইন্টাল ।
প্রান্তিক উৎপাদন a, b, c ও d বিন্দুগুলো যোগ করলে প্রান্তিক উৎপাদন রেখা (MP) পাওয়া যায় । MP রেখা সর্বোচ্চ উৎপাদনের পর ডান দিকে নিম্নগামী হয়েছে । অর্থাৎ এখানে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি কার্যকর হয়েছে।
রাজশাহীর নূরু মিয়া ২ একর জমিতে লিচু বাগান করেছেন । বাগানে প্রায় ১০০টি লিচু গাছ আছে । এ বছর বিভিন্ন ধরনের উপকরণ বাবদ ২০ হাজার টাকা ব্যয় হয় । লিচুর ফলনও ভালো হয় । নূরু মিয়া ও তার ছেলে ঘুম ও আরাম ত্যাগ করে বাদুড় ও অন্যান্য পাখির উপদ্রব থেকে বাগানকে রক্ষা করেন । এই লিচু বাগানের জন্য দুধরনের খরচ হয়। ১. উপকরণ বাবদ ব্যয় অর্থাৎ আর্থিক উৎপাদন ব্যয় এবং ২. ঘুম ও আরাম ত্যাগ অর্থাৎ মানবিক কষ্ট। প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় পরিমাপ করতে হলে এই দুই ধরনের ব্যয়কেই বিবেচনায় নিতে হবে। এদের সমষ্টিকে প্রকৃত উৎপাদন ব্যয় বলে ।
কোনো উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান ভাড়া বা উপকরণ বা শ্রমশক্তি ক্রয়ের জন্য দৃশ্যমান যে ব্যয় করেন, এদের সমষ্টিকে প্রকাশ্য ব্যয় বলে । যেমন উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান বা ফার্মে কর্মরত মানুষের বেতন ও ভাতাদি, কাঁচামাল, মাধ্যমিক দ্রব্য ক্রয়ের জন্য ব্যয়, বিভিন্ন ধরনের স্থির ব্যয় যেমন, বাড়ি ভাড়া, মূলধনের সুদ ইত্যাদি ।
অপ্রকাশ্য ব্যয় বলতে উদ্যোক্তার নিজের শ্রমের মূল্য ও অন্যান্য ব্যয়, স্বনিয়োজিত সম্পদের খরচ যেমন, নিজের বাড়িতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কারখানা স্থাপন, অফিস বানানো, ইত্যাদি প্রকাশ করে । এ ধরনের ব্যয় ফার্মের হিসাব বইয়ে থাকে না। যেমন, ব্যক্তিমালিকানাধীন ফার্মের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের বেতন পৃথকভাবে হিসেব না করে মুনাফাকে তার সেবার পারিশ্রমিক হিসাবে গণনা করে । এ ক্ষেত্রে মালিকের যেকোনো রকমের ভাতাদি অপ্রকাশ্য ব্যয় হিসাবে গণ্য হয় ।
উপরে আমরা আর্থিক উৎপাদন ব্যয়, প্রকৃত উৎপাদন ব্যয়, প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ব্যয়ের ধারণা পেয়েছি । এবার আমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক ব্যয় সম্পর্কে জানবো।
কোন ফার্ম বা উৎপাদনী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সম্পদ বা উপকরণ ক্রয়ের জন্য সরাসরি যে পরিমাণ আর্থিক ব্যয় এবং অপরাপর অপ্রকাশ্য ব্যয় করে এদের সমষ্টিকে ব্যক্তিগত ব্যয় বলে। এক কথায় উৎপাদনের সাথে জড়িত ব্যক্তির সব ধরনের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ব্যয়ের যোগফল হচ্ছে ব্যক্তিগত ব্যয়। উৎপাদন বা ভোগ করতে গেলে উৎপাদন বা ভোগ প্রক্রিয়ার বাইরে সমাজের নানা ব্যক্তি অনেক সময় অপ্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে যে মোট অর্থের প্রয়োজন পড়ে, সেই পরিমাণ অর্থই হলো সামাজিক ব্যয়।
যেমন, শহর এলাকায় বসবাসরত লোকদের মটরগাড়ির ধোঁয়া শহরের লোকদের শারীরিক ক্ষতি করে। এ জন্য সমাজকে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাবদ যে পরিমাণ ব্যয় বহন করতে হয়, তাকে সামাজিক ব্যয় বলে । সামাজিক ব্যয়ে ব্যক্তিগত ব্যয় প্রতিফলিত হলেও ব্যক্তিগত ব্যয়ে সামাজিক ব্যয় প্রতিফলিত না-ও হতে পারে। সামাজিক ব্যয় ব্যক্তিগত ব্যয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও তা সাধারণত ব্যক্তিগত ব্যয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না।
আরও দেখুন...